বীরে মাউনার যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবীর শহীদ হওয়ার হৃদয় বিদারক ঘটনা

বীরে মাউনার যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবীর শহীদ হওয়ার হৃদয় বিদারক ঘটনা 



হযরত মুগীরা ইবনে আবদুর রহমান (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযম (রাঃ) বলেন,  আবু বর আমের ইবনে মালেক ইবনে জা'ফর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে মদীনায় আসিল।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহার কাছে  ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন । সে দাওয়াত  কবুল  করিল না এবং দাওয়াত  কবুলে অনিচ্ছাও প্রকাশ করিল না। 

সে বলিল, হে মুহাম্মাদ, আপনি  নাজাসীদের নিকট যদি সাহাবাদের পাঠাইয়া দেন, আর তারা যদি  তাহাদিগকে দাওয়াত দেয় তবে আমি আশা করি তাহারা আপনার দ্বীন মানিয়া লইবে।


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, নাজদবাসীদের পক্ষ হইতে আমি আমার সাহাবাদের ব্যাপারে আশঙ্কা বােধ করি। আবু বার বলিল, আমি তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব  নিলাম।

 অতএব আপনি তাহাদিগকে প্রেরণ করুন যাহাতে তাহারা তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সায়েদাহ গোত্রের মুনযির ইবনে আমর সহ সত্তরজন সাহাবাকে প্রেরণ করিলেন ।


যাহাদের মধ্যে হযরত হারেস ইবনে সিম্মাহ, বনু আদী ইবনে নাজ্জার গােত্রের হযরত হারাম ইবনে মিলহান, হযরত ওরওয়া ইবনে আসমা ইবনে সাত সুলামী, হযরত নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা খুযাই, হযরত আবু বকর (রাঃ) এর গােলাম হযরত আমর ইবনে ফুহাইরাহ (রাঃ) ও আরাে অন্যান্য বিশিষ্ট মুসলমানগণও ছিলেন।

 তাহারা মদীনা হইতে রওয়ানা হইয়া বীরে মাউনা নামক স্থানে পৌছিলেন। ইহা বনু আমেরের এলাকা ও বনূ সুলাইমের প্রস্তরময় ময়দানের মধ্যবর্তী একটি কুয়ার নাম।

 সেখানে পৌঁছে তারা,  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি দিয়া হযরত হাম ইবনে মিলহান (রাঃ) কে আমের ইবনে তােফায়েলের কাছে পাঠাইলেন। 

হযরত হারাম (রাঃ) আমেরের নিকট পৌঁছিলে সে চিঠির প্রতি ক্ষেপই করিল না, বরং হযরত হারাম (রাঃ) এর উপর আক্রমণ করিল এবং তাহাকে শহীদ করিয়া দিল। তারপর সে সাহাবা (রাঃ)দের বিরুদ্ধে আপন গােত্র) বন্ আমেরের নিকট সাহায্য চাহিল।


 কিন্তু বনূ আমের তাহার ডাকে সাড়া দিতে অস্বীকার করিল এবং তাহারা বলিল, আবু বার যেহেতু এদেরকে নিরাপত্তা দিয়াছে এবং তাদের সহিত অঙ্গীকার বদ্ধ হইয়াছে তাই  আমরা তাহার ওয়াদা ভঙ্গ করিতে পারি না।

অতঃপর আমের সাহাবাদের বিরুদ্ধে বন্ সুলাইম, উসাইয়াহ, রেল ও যাকওয়ান গােত্রসমূহের নিকট সাহায্য চাহিল। তাহারা এই কাজে সাড়া দিল। সুতরাং এই সমস্ত গোত্ৰসমূহ এক জোট হইয়া আসিল এবং মুসলমানদের অবস্থানস্থলকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিল।

মুসলমানগণ গােত্রসমূহকে দেখিয়া নিজেদের তলোয়ার ধারণ করিলেন এবং  যুদ্ধ শুরু  করিলেন। এবং  সবাই শহীদ হইয়া গেলেন। একমাত্র বনু দীনায় ইবনে নাজ্জারের হযরত কা'ব ইবনে যায়েদ (রাঃ) জীবিত রহিলেন। 


কাফেরেরা  মৃত  মনে করে চলে যায়। পরে তাহাকে  উঠাইয়া আনা হয় এবং পরে  তিনি বাঁচিয়া যান। পরবর্তীতে খন্দকের যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। 

হযরত আমর ইবনে উমাইয়া যামরী (রাঃ) ও বনু আমর ইবনে আওফ গােত্রের একজন আনসারী সাহাবী (রাঃ) এই দুইজন মুসলমানদের পশু চরাইবার জন্য গিয়াছিলেন। 

তাহারা মুসলমানদের অবস্থানস্থলে (মৃতভােজী) পাখী উড়িতে দেখিয়া মুসলমানদের আক্রান্ত হওয়ার কথা বুঝিতে পারিলেন। সুতরাং তাহারা বলিলেন, আল্লাহর কসম, এই পাখীগুলো  উড়ার পিছনে অবশ্যই  কোন   কারণ রহিয়াছে। 

তারা দুজনেই  দেখার জন্য রওনা  হইলেন এবং আসিয়া দেখিলেন, সবাই মুসলমান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়িয়া আছেন এবং যে সকল ঘােড়সওয়াররা তাদেরকে কতল করিয়াছে তারা সেখানে দাড়িয়ে রয়েছে। 


এই দৃশ্য  দেখে  হযরত আমর ইবনে উমাইয়া (রাঃ) কে বলিলেন, তােমার কি রায়? হযরত আমর (রাঃ) বলিলেন, আমার রায় হল,  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমরা  এই ঘটনার জানাই । 

আনসারী সাহাবি বলিলেন, আমি আমার জন্য  এই জায়গা ছাড়িতে পারি না যেখানে হযরত মুনযির ইবনে আমর (রাঃ) কে শহীদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। 

আর আমি জীবিত থেকে তার  শহীদ হওয়ার কথা শুনিতে চাই না। এই কথা বলিয়া তিনি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ শুরু  করলেন এবং শহীদ হইয়া গেলেন। 

কাফেররা হযরত আমর ইবনে উমাইয়া (রাঃ)কে বন্দী করিল। তিনি যখন তাহাদের নিকট নিজেকে মুদার গােত্রীয় বলিয়া প্রকাশ করিলেন তখন আমের ইবনে তােফায়েল তাহাকে মুক্ত করিয়া দিল।(বিদায়াহ)


 নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  হযরত হারাম (রাঃ)কে সত্তরজন আরােহীর এক জামাতের সহিত প্রেরণ করিলেন। (উক্ত এলাকার) মুশরিকদের সর্দার আমের ইবনে তােফায়েল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে  যে কোন একটি গ্রহণের জন্য বলিলেন।

 সে বলিয়াছিল যে, গ্রামের অধিবাসীগণ আপনার অধীন থাকিবে আর শহরের অধিবাসীগণ আমার অধীন থাকিবে, আর না হয় আপনার পর আমাকে আপনার খলীফা নিযুক্ত করিবেন। 

নতুবা আমি গাতফান গােত্রের হাজার হাজার সৈন্য লইয়া আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিব। আমের  এক মহিলার ঘরে ছিলেন যার নাম উম্মে ফুলান।


 এমতাবস্থায় সে প্লেগ রােগে আক্রান্ত হইল এবং বলিল, আমার প্লেগ রােগের ফোড়া হইয়াছে। (সফর অবস্থায় সাধারণ এক মহিলার ঘরে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণকে নিজের জন্য অপমানকর মনে করিয়া বলিল, ) আমার ঘোড়া আন।

 অতঃপর (ঘােড়ায় চড়িয়া রওয়ানা হইল এবং) ঘােড়ার পিঠেই তাহার মৃত্যু হইল। হযরত উম্মে সুলাইম (রাঃ)এর ভাই হযরত হারাম (রাঃ) ও একজন খোড়া সাহাবী ও অমুক গােত্রের এক ব্যক্তি ইহারা তিনজন চলিলেন।

হযরত হারাম (রাঃ) তাহার উভয় সঙ্গীকে বলিলেন, আমি তাহাদের নিকট যাইতেছি, আর তােমরা দুইজন নিকটবর্তী কোন স্থানে অবস্থান কর। 

যদি তাহারা আমাকে নিরাপত্তা দেয় তবে তােমরা তাে নিকটেই আছ, আর যদি তাহারা আমাকে কতল করিয়া দেয় তবে তােমরা আপন সঙ্গীদের নিকট চলিয়া যাইবে। 

অতঃপর হযরত হারাম (রাঃ) সেখানে যাইয়া লােকদেরকে বলিলেন, তােমরা কি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পয়গাম পৌঁছাইবার জন্য নিরাপত্তা দিবে? তিনি তাহাদের সহিত কথাবার্তা বলিতেছিলেন। 

এর মধ্যে একজনকে তারা ইশারা করিল, আর সে পিছন দিক থেকে  তাকে বর্শা মারিল। এমতাবস্থায় হযরত হারাম (রাঃ) বলিয়া উঠিলেন, আল্লাহু আকবার, কা'বার রবের কসম, আমি সফলকাম হইয়াছি। 

ইহা দেখিয়া তাহার সঙ্গী মুসলমানদের সহিত যাইয়া মিলিত হইলেন। তারপর  খোড়া সাহাবী ছাড়া  সকল মুসলমানকে শহীদ করিয়া দেওয়া হইল।  


খোড়া সাহাবী পাহাড়ের উপর  ছিলেন। এই সকল শহীদদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করিয়াছিলেন যাহা পরবর্তীতে মানসুখ বা রহিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

অর্থ ঃ ও নিঃসন্দেহে আমরা আমাদের রবের সহিত মিলিত হইয়াছি, তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন এবং তিনি আমাদিগকে সন্তুষ্ট করিয়াছেন।

 নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য ত্রিশদিন পর্যন্ত রেল, যাকওয়া, বনু লেহইয়ান ও উসাইয়াহ গােত্রসমূহের বিরুদ্ধে বদদোয়া করিয়াছেন, যাহারা আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করিয়াছে।


বােখারীর রেওয়ায়াতে আছে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, তাহার মামা হযরত হারাম ইবনে মিলহান (রাঃ)কে যখন বীরে মাউনার ঘটনার দিন বর্শা  মারা হইল তখন তিনি নিজের রক্ত লইয়া আপন মুখমণ্ডল ও মাথার উপর ছিটাইতে লাগিলেন। 

অতঃপর বলিলেন, কা'বার রবের কসম, আমি সফলকাম হইয়া গিয়াছি। ওয়াকেদী বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি তাকে  শহীদ করেছিল তাহার নাম হইল জাব্বার । 

জাব্বার (হযরত হারাম (রাঃ)এর কথা শুনিয়া) জিজ্ঞাসা করিল, 'আমি সফলকাম হইয়া গিয়াছি এই কথার কি অর্থ? লােকেরা তাহাকে বলিল, ইহা বেহেশত পাওয়ার সফলতা। 

অতঃপর জাব্বার বলিল, আল্লাহর কসম, সে সত্য বলিয়াছে। পরবর্তীতে জাবার এই কারণেই ইসলাম গ্রহণ করিলেন।(বিদায়াহ)

Post a Comment

0 Comments